কে?
কে তুমি?
এসেছ আমার শূন্যপ্রাঙ্গণে-
কে?
কে তুমি?
ভুলাতে চাও আমায় সাত কোটি জনতার করুণার্তনাদ-
পিতৃহারা, পুত্রহারা, ভ্রাতা-ভগ্নী-স্বজনহারার দুঃসহ বেদনা!
কে তুমি?
ফিরিয়ে দিবে সেই আনন্দমুখর করোজ্জ্বল দিবস,
পাখিডাকাভোর, স্নিগ্ধপ্রভাত, চন্দ্রিমারজনী,
দোলনায় ঘুমন্ত শিশুর মতো চিন্তামুক্ত জননী।
কে তুমি?
হৃদয়বান!
ফিরিয়ে দিতে পার-
ভুলাতে পার ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তদান
অগণিত মুক্তিবীরের আত্মত্যাগ
রক্তসাগর
বাংলার করুণ-ইতিহাস
পারবে?
পারবে না বন্ধু।


এখানে-
এই যে কাঁঠালগাছ
এর ডালে বসে ক’টি দোয়েল পাখি সকাল-সাঁজে করত চেঁচামেছি
অহরহ কলতান-
বহুদিন ধরে দেখি না তাদের আর
শুনি না মধুডাক!
মনে হয়-
মনে হয় হারিয়ে ফেলেছে স্মরণশক্তি তারা
আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট শব্দে
মনে হয় ভুলে গেছে নীড়!
কিবা বয়ে গেছে তাদের পরে
সেই কালরাত্রির অকাল ঝড়ের বাতাস!
এসব কি ভুলা যায়?
চারিদিকে গুলিবর্ষণ- শাশ্বত বর্ষণ-
ভয়ঙ্কর শব্দ;
বিহগের ঠাঁই নেই বাগানে!
পশুদের ঠাঁই নেই অরণ্যে!
সূর্য মলিন, চন্দ্র মলিন, ধূম্রধরণী
প্রলয়ান্ধার- চতুর্দিকে অন্ধকার-
বিষণ্ন নগরী।


এখানে লাশ!
ওখানে লাশ!
যেখানে-সেখানে পচা মাংসের গন্ধ
মক্ষিকা বিহ্বল-
রক্তে রঞ্জিত ঘাস
বাংলার শ্যামল প্রকৃতি,
ধূসরজমাট স্নিগ্ধ পথের ধূলি
অগ্নিতপ্ত- খাঁখাঁ বঙ্গধরিত্রী-
হাটে নেই মানুষ!
ঘাটে নেই মানুষ!
শূন্য রাহা!
শূন্য মাঠ!
শুধু-
শুধু শকুন-শকুনীর হাট- কুকুরের মেলা-
বাতাসে আজও ভাসে পচা মাংসের গন্ধ!
বহুদিন ধরে ঘুম নেই আমার
ঘুমুতে পারি নে আমি
শয়নে-স্বপনে ভাসে দু-নয়নে অনর্গল,
ভাসে অনর্গল-
ধর্ষিতা ভগিনীর রক্তাক্ত লাশ!
ধর্ষিতা ষোড়শীর গলায় ফাঁস!
পবিত্র রমণীর কাটাস্তন!
বৃদ্ধা জননীর বাকশক্তি হারানো ব্যথা
বৃদ্ধ জনকের মেধাশক্তিলোপাট-
আমাকে কষ্ট দেয়, তাড়না করে,
সতত ভাবায়;
সদা চিন্তামগ্ন আমি
কেমনে ভুলে যাই?
সেই দুঃখদিনের অসহবেদনা
আমাকে ভুলাতে পারে কে?
কে তুমি?
স্বরাজ!

আজ আমি স্বাধীন!
হা-হা-হা-
হাসিতে কণ্ঠ শুকে আমার
ঝরে পড়ে অশ্রু- খুশির অশ্রু-
আজ আমি স্বাধীন!
পাক গেছে পাঁকে-
পবিত্র হয়েছে বাংলার মাটি!
তবু-
বন্ধু,
তবু অন্তরের দুঃখসব রয়ে যায় অন্তরে।
অস্ত যবে যায় বাংলার দিবাকর
রাজ্য যবে রাজাহারা
সমস্ত প্রজা যেখানে নির্বাক
সেখানে আমি-
সেখানে আমি সবাক!
কারে নিয়ে মাতি- করি উল্লাস- গড়ি সংসার- বাঁধি সুখের ঘর
আমার যে কেউ নেই আজ!
বড়ই নিঃসঙ্গ নিঃসহায় নিঃস্ব আমি
আত্মীয়-অনাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব
সবে তো মিশে গেছে মৃত্তিকায়-
ধুলায় হয়েছে বিলীন!
কেমনে ভুলে যায় আমি সেই প্রলয়দিনের কাহিনী-
ভুলতে পারি আমি?


কত দেখেছি তাঁদের গোধূলি-লগ্নে সন্ধ্যা-আঁধারে
চুপিচুপি গুটিগুটি পায় আমার অগ্রজ ফিরছে বাড়ি
দুয়ারে দাঁড়িয়ে মা- অমনি বদ্ধ দুয়ার
কোথায় লুকায় পুত্রে- হায়েনারা খোঁজে
কাশবনের ধারে কি যেন লুকাইয়া আসে পাশের বাড়ির মিলির ভাই
আজ তাঁরা কেউ নাই-
নষ্ট মিলি!
নষ্ট তার জননী!
কষ্টে আড়ষ্ট মাতা-পুত্রী-
লজ্জা-ঘৃণায়, দুঃখ-ক্রোধে করেছে গরল পান
জননী-দুহিতার একসঙ্গে জীবনদান!


তাই-
তাই ভুলতে পারি না ভাই,
এসব অসহদিনের গ্লানি আমাকে যদি পাহাড়সম সুখ দেয় আনি
তবু-
তবু আমি মুগ্ধ নই,
মাতৃদুগ্ধ যদি করে থাকি পান
কণ্ঠে যতক্ষণ থাকে প্রাণ
ভুলব না আমি-
ভুলতে পারি না আমি তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মহৎকদম
বিধাতার কসম-
আমি চলে যেতে চাই- চলে যাব তবে,
আমার আর কিবা প্রয়োজন শান্তাকাশ
অপূর্বসংসার
হিমাচলের মতো বিশাল অট্টালিকা
মর্মর পাথরে গাঁথা দালানকোটা
হেলেনের রাজপ্রাসাদ, মমতাজের মহল
আমার আর কী প্রয়োজন?


তাদের দরকার- বড়ই প্রয়োজন
বন্ধু!
তাদের শুনাইও তবে
আজকের এ ক্লান্তির দুপুর, শ্রান্তির রাত, ক্রান্তির কথা
শুনাইও তবে-
আমাদেরও ছিল হাট, মিলনমেলা, উৎসব, আনন্দোল্লাস, মুখরদিবস,
হাসি-কান্না-গান, মমত্বের স্থান, প্রীতির বন্ধন, বৈশাখের মুগ্ধপ্রভাত,
আরও-আরও-আরও
শুনাইও অগ্রজের কথা- আত্মদান
বাহান্নের প্রখরমিছিল- তীক্ষ্ণবাণী
রক্তে পথপিছিল- রাজপথ খালি
তোমাকে অর্জন- আজকের তুমি
তোমাকে তাদের বড়ই প্রয়োজন
বন্ধু!
বড়ই প্রয়োজন।
২২ কার্তিক, ১৪১৪-
মানামা, আমিরাত।